বালিয়াটি জমিদার বাড়ির ইতিহাস

নিত্যানন্দ রায়ের দু’ পুত্র বৃন্দাবন ও জগন্নাথ ঢাকা , ময়মনসিংহ, বরিশাল, ফরিদপুর ও ত্রিপুরা জেলায় অনেক জমিদারী ক্রয় করে তৎকালীন পূর্ববংঙ্গের জমিদার শ্রেণীভুক্ত হন । বৃন্দাবনের শারীরিক শক্তি সম্পর্কে অনেক কিংবদন্তী আছে । পঁচিশ-ত্রিশ জন বলিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষ একত্রে যে জিনিস উত্তোলনে সমর্থ না হত বৃন্দাবন চন্দ্র একাকী অনায়াসে তা করতে পারতেন। একসময় ভারতের তীর্থস্থান বৃন্দাবনে তিনি যাচ্ছিলেন… কিংবদন্তী আছে কোন এক নদীর তীরে তার তার সঙ্গীদের সাথে নীলকুঠির লোকজনের বিবাদ লেগে গেলে নীলকুঠির সাহেব তাদের নৌকা আটক করার জন্যে দু-শতাধিক লোক পাঠিয়েছিলেন। কিন্ত বৃন্দাবন একমাত্র লাঠি দিয়ে ঐ লোকগুলোকে কুঠিতে তাড়িয়ে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন । নীলকুঠির সাহেব তৎক্ষনাৎ বৃন্দাবন চন্দ্র কে গুলি করবার জন্য বন্দুক বের করলে মেম সাহেব পূর্বাপর ঘটনা জানতে পেরে সাহেব কে বাধা ‍দিয়েছিলেন । বীরপুরুষকে এভাবে গুলি করা ভীরুতার কাজ । এই ভেবে সাহেব বৃন্দাবন চন্দ্রকে সমাদর করে কুঠিতে নিয়ে যান এবং নানাভাবে তাকে আপ্যায়িত করে বহু উপাহার প্রদান করেছিলেন।

এই বাড়ির জমিদার বৃন্দাবন ও জগন্নাথ, দুইভাই ছিলেন নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব । তারা সুদৃশ্য কষ্টিপাথরের তৈরি উভয় পাশে রাধিকা ও ললিতা সখি সমন্বয়ে কৃষ্ণমূর্তি রাধা বল্লব বিগ্রহ বালিয়াটিতে প্রতিষ্ঠা করেন। সেই মন্দিরের সম্মুখ ভাগেই ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন ‘রাধা বল্লব ফ্রী প্রাইমারী স্কুল’। ১৯৬৪ সনে সে স্কুলটির স্থান পরিবর্তন ও নাম পরিবর্তন হয় বালিয়াটি এম, এফ, পি স্কুল । বর্তমানে সরকারী নিয়ন্ত্রণে বালিয়াটি আদর্শ / মডেল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। সরকারীভাবে এ  বিদ্যালয়ের বেশ উন্নয়ন কর্মকান্ড ইতোমধ্যে হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে সাটুরিয়া উপজেলায় এ বিদ্যালয়টি একটি মডেল। এছাড়াও পূর্ববাড়ির জমিদারদের সঙ্গে একত্রে এ বাড়ীর জমিদাররা ভারতের বৃন্দাবনে “গোপাল জিউ মন্দির ও কুঞ্জ” প্রতিষ্ঠা করেন । ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের পুরী জগন্নাথ মন্দিরে বালিয়াটির জমিদারদের প্রস্তর ফলক আছে । এছাড়া কাশীতেও্ এদের কীর্তির হদিস মিলবে বলে আশা করা যায়। নারায়নগঞ্জে “ লক্ষী নারায়ণ জিউ” নামে যে আখড়াটি আছে সেটা এই জমিদারদেরই অবদানের চিহ্ন।  

জগন্নাথ রায় চৌধুরী মৃত্যুর পূ্র্বক্ষণে তার জমিদারী এস্টেটের ম্যানেজার তৎকালীন সাভার থানাধীন শিমুলিয়া ইউনিয়নের নৈহাটী গ্রামের গিরিশ চন্দ্র দত্তের কাছে নাবালক তিন ছেলেকে সোপর্দ করে বলে যান এই  জমিদারীর দায়-দায়িত্ব তোমার উপর থাকল , কারন ওরা এখন নাবালক। পরবর্তীতে তিন ভাই সাবালক হলে এদের মধ্যে কিশোরী লাল ম্যানেজার গিরিশ চন্দ্র দত্তকে এস্টেট চালানোর দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করে দত্ত বাবুকেই বললেন ,“ কাকা জমিদারী এস্টেট পরিচালনা করার দায়িত্ব আপনিই গ্রহণ করুন” । এই অনুরোধ সত্বেও লোক অপবাদের ভয়ে তিনি এ প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। গিরিশ চন্দ্রের পূর্বে এই এস্টেটের ম্যানেজার ছিলেন তার কাকা শিব চরণ দত্ত । শিব চরণ দত্তের মৃত্যুর পর গিরিশ চন্দ্র ম্যানেজারের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

কিশোরী বাবু খুব সৌখিন ব্যক্তি ছিলেন।তিনি জুতা পড়তেন ইটালি থেকে ফরমাইশ দিয়ে তৈরী করে এনে তার পরিধেয় বস্ত্র আসতো ফ্রান্স থেকে ধোলাই করে। ভারতের স্বায়ত্বশাসন বিধি প্রবর্তনের কারণে তৎকালীন গর্ভনর জেনারেল লর্ড রিপন যখন ১৮৮৪ ‍খ্রিষ্টাব্দে ভারত ত্যাগ করেন তখন বোম্বাইয়ে ( বর্তমান মুম্বাইয়ে ) আয়োজিত তার বিদায় অভিনন্দন অনুষ্ঠানে এই বাড়ির জমিদার ব্রজেন্দ্রকুমার ল্যান্ডহোল্ডারসদের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন। তিনি সাতিশয় পরদুঃখ কাতর ব্যক্তি ছিলেন। কেউ কখনও অপরের নির্যাতনের ভয়ে তার কাছে আশ্রয়প্রার্থী হলে তিনি তাকে রক্ষা করার জন্য অকাতরে টাকা পয়সা ব্যয় করতে কুন্ঠিত হতেন না । একবার এক বিধবা ব্রাক্ষ্মণ ললনাকে তিনি জনৈক তালুকদারের লোলুপ দৃষ্টি থেকে মামলা  মোকদ্দমা করে নিজে টাকা পয়সা ব্যয় করে রক্ষা করে ছিলেন । তার জমিদারীভুক্ত ধামরাই অঞ্চলে ঐ দুর্ভিক্ষের সময়ে বাজার মূল্য হতে অনেক কম মূল্যে বহু লোককে ধান দিয়েছিলেন এবং নিতান্তই গরীব দুঃখীকে বিনামূল্যে ধান বিতরণ করেছিলেন।

তিনি ছিলেন নিঃসন্তান।তাই পোষ্য হিসেবে এনেছিলেন সুরেন্দ্রকুমারকে। সুরেন্দ্রকুমার ঢাকা সদরে কয়েক বছর অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন । তিনি ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনারের দায়িত্ব পালন করে প্রশংসা ভাজন হয়েছিলেন। সুরেন্দ্রকুমার অত্যন্ত বুদ্ধিমান , বিচক্ষণ , তেজস্বী , বিদ্যৎসাহী ও পরদুঃখকাতর ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

জমিদারদের প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান:

কিশোরীলাল রায় চৌধুরী ১৮৮৪ খ্রিঃ ঢাকার তৎকালীন চিত্তরঞ্জন্ এভিনিউতে বিখ্যাত জগন্নাথ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯২৬ সনের ৯ জানুয়ারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ঢাকা জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজে বক্ততা করেন। এখন একটু পিছন ফিরে দেখা যাক। জগন্নাথ স্কুল থেকে আজকের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ১৮৬৮ সালে জগন্নাথ রায় চৌধুরী নিজ নামে জগন্নাথ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন

১৮৮২ সালে ডঃ দীনেশ চন্দ্র সেন এ স্কুল থেকে এন্ট্রাস পাশ করেন। ১৮৮৪ সালে  জগন্নাথ রায় চৌধুরীর পুত্র কিশোরীলাল রায় চৌধুরী স্কুলটিকে্‌ উচ্চ মাধ্যমিকে উন্নীত করেন। মাত্র ৪৮ জন ছাত্র নিয়ে কলেজ শাখার যাত্রা শুরু । ১৮৮৭ সালে স্কুল শাখা কলেজ শাখা থেকে আলাদা হয় । স্কুল শাখার নাম দেওয়া হয়  কে, এল , জুবিলি হাই স্কুল। যে হাই স্কুলটি এখোনো স্বমহিমায় উজ্জ্বল। ঢাকার ফরাসগঞ্জের মোহিনী মোহন দাসের বাড়ীতে ১৯০১ খ্রিঃ ১৯ শে মার্চ থেকে টানা সতেরো দিন স্বামী বিবেকানন্দ আতিথ্য গ্রহন করেছিলেন। ৩০ মার্চ ১৯০১ তারিখে তিনি ঢাকার স্বনামধন্য আইনজীবী রমাকান্ত নন্দীর সভাপতিত্বে  জগন্নাথ কলেজ ইংরেজীতে বক্ততা করেন। বক্ততার বিষয় ছিল “আমি কি শিখেছি “ । জগন্নাথ কলেজে বক্ততা শ্রবণে যারা ব্যর্থ হয়েছিলেন তারা পরের দিন ৩১ মার্চ ১৯০১ ঢাকাস্থ পগোজ স্কুল মাঠে স্বামীজীর বক্ততা শুনেছিলেন । স্বামীজী সেদিনও ইংরেজীতেই বক্ততা দিয়েছিলেন। বক্ততার বিষয় ছিল “ আমাদের জন্মপ্রাপ্ত ধর্ম “। ১৯২১ সালে কলেজটির নাম হয় জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজে । ১৯৪২ সালে কলেজের অধ্যক্ষ শৈলেন্দ্র নাথ ঘোষ স্বীয় কন্যাকে এই কলেজে প্রথম ভর্তি করে কলেজে সহশিক্ষা চালু করেন। শ্রী ঘোষ ছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর একসময়ের সহচর। ১৯৬৭ সালে হামিদা রহমান কলেজের শিক্ষিকা হিসেবে প্রথম যোগদান করেন। ১৯৬৮ সালে তৎকালীন সরকার এ কলেজটিকে সরকারের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নাম দেন সরকারী জগন্নাথ কলেজে । ২০০৫ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণার মধ্যে দিয়ে এটি এখন পূর্নাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে উল্লেখ্য ভারতীয় Legislative Council  এ Jagannath College Act নামে আইন পাস করা হয় ১৯২০ সনের ২০ শে মার্চ । ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর জগন্নাথ কলেজের গতি পথকে অবনমিত করার প্রয়াস চালানো হয়। স্নাতক থেকে নিয়ে আসা হয় উচ্চ মাধ্যমিকে। শুধু তাই নয় জগন্নাথ কলেজের অনেক গুণী শিক্ষক জগন্নাথ কলেজ লাইব্রেরীর বহু মূল্যবান বই পুস্তকে সমৃদ্ধ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এখন স্কুলের কথায় আসা যাক। ১৮৮৬ সনে  ব্রাহ্মধর্মের একনিষ্ঠ সেবক শ্রী অনাথ বন্ধু  মল্লিক ঢাকা ব্রাহ্মবিদ্যালয়  স্থাপন করেন। পরবর্তীতে কিশোরীলাল এ বিদ্যালয়ের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার সিংহাসন আরোহণের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে কিশোরীলাল এ বিদ্যালয়ের নামকরণ করেন কিশোরীলাল জুবিলি হাই স্কুল। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দ ছোট লাট কারমাইকেল সাহেব বাংলার বিভিন্ন বিদ্যালয় পরিদর্শন শেষে মন্তব্য করেছিলেন “ আমার ‍পরিদর্শনকৃত বিদ্যালয় গুলোর মধ্যে এটাই ( জুবিলি হাই স্কুল ) বৃহত্তম”।

ঢাকার সুপ্রসিদ্ধ  ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার ও কিশোরীলালের অর্থে স্থাপিত ও পরিচালিত হয়েছে । ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দ ৩ জুন কিশোরী লাল পরলোক গমন করে। ১৮৮৪-১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল জগন্নাথ ‍ কলেজ পরিচালিত হয় ট্রাস্টি বোর্ডের পরিচালনায়। ট্রাস্টিরা ছিলেন যথাক্রমে রায় চন্দ্র কুমার দত্তবাহাদুর , আনন্দ চন্দ্র রায়, যশোদা লাল রায় চৌধুরী, কুমার রণেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী ও ‍দীনেশ চন্দ্র রায় চৌধুরী।

কিশোরীলালের ভাই যশোদালাল বালিয়াটিতে এ্র্যালোপ্যাথিক দাতব্য ‍চিকিৎসালয় স্থাপন করেন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের মন্ত্রশিষ্য শ্রীমৎ স্বামী সুবোধানন্দজী মহারাজ এবং এ  ‍চিকিৎসালয়টি উদ্বোধন করেছিলেন ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ জে. সি. ড্রামন্ড ।  ‍চিকিৎসালয়টি বর্তমানে সরকারী নিয়ন্ত্রনে ‘ বালিয়াটি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র নামে এলাকার জনসাধারণকে ‍চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

যোগেন্দ্র লাল রায় চৌধুরী ( মনি বাবু ) বালিয়াটীতে খেলাধুলার মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছেন । একটানা বহু বছর তিনি বালিয়াটি ইউনিয়ন কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

জীতেন্দ্র লাল রায় চৌধুরী ১৯৫৮ সন পর্যন্ত টানা সতের বছর নারায়ণগঞ্জে অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট ‍ছিলেন । তার ব্যক্তিগত পাঠাগারের বহু মূল্যবান বই বালিয়াটি পাবলিক লাইব্রেরীর সহসভাপতি ছিলেন । তার ব্যক্তিগত পাঠাগারের বহু মূল্যবান বই বালিয়াটি পাবলিক ক্লাব ও লাইব্রেরীকে দান করেছিলেন । সংস্কৃতি চর্চা তথা নাট্যভিনয় ও নাট্য পরিচালনায় তিনি অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় রেখেছেন ।১৩৯৪ বঙ্গাব্দের আষাঢ়ে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে নারায়ণগঞ্জে তিনি পরলোকগমন করেন।

 হিরা লাল রায় চৌধুরী বালিয়াটির দক্ষিনপাশে তার বাগান বাড়ীতে পুকুরের মাঝে সুডৌর প্রমোদ ভবন নির্মাণ করেন। অদ্যবধি তার ভগ্নাবশেষ সেখানে বিদ্যমান রয়েছে।

চূণী লাল ছিলেন হিরা লালের পোষ্য পুত্র। বালিয়াটি মধ্যবাড়ী থেকে হিরা লাল চূণী কে দত্তক নিয়েছিলেন । ১৩৪৩ বঙ্গাব্দের ৮ ই ফাল্গুন বালিয়াটী পুরাতন বাজারে তিনি কালীমন্দির স্থাপন করেন । সেখানে আজও ধুমধুামে পুজো হয় । এই কালী মন্দিরের পূর্ব পাশে স্থাপন করা হয়েছে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সৈনিক বেশে এক  পূণাঙ্গ মূর্তি। রড ‍সিমেন্ট নির্মিত এ মূর্তিটি তৈরি করেছিলেন।

বালিয়াটির সন্তান প্রমথ কর্মকার । অর্থায়ন করেছিলেন তৎকালীন বালিয়াটি ইউনিয়ন কংগ্রেস ।

চূণী লালের চার ছেলে জীবন লাল , প্রবল ,প্রণব, প্রবীর । প্রবল সন্ত্রিক ১৯৭১ সনে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে নারায়ণগঞ্জে নিহত হন। জীবন লাল ভাল একজন আবৃতিকার ও নাট্যাভিনেতা ছিলেন। ১৯৮০ সনে ‍তিনি ভারতের পশ্চিম বাংলার খড়দা চলে যান । তিনি একাধিক দার পরিগ্রহ করেছিলেন করেন। পশ্চিম বাংলায় পরলোক গমনের সময় ‍তিনি প্রথম পক্ষের স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্র সন্তান শংকর রায় চৌধুরী ও সমাপ্ত রায় চৌধুরী এবং দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর গর্ভজাত একমাত্র সন্তান প্রতাপ লাল রায় চৌধুরীকে  রেখে যান। শংকর ও সমাপ্ত খড়দায় অবস্থান করছিলেন । পরবর্তীতে সমাপ্ত খড়দাতে পরলোক গমন করেন। শংকর এখন ‍কলকাতায় । প্রতাপ  রায় চৌধুরীই এখন বাংলাদেশে জীবনলাল  রায় চৌধুরীই একমাত্র উত্তরাথধিকারী । বর্তমানে তিনি তার মামার বাড়ী টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর থানার জামুর্কী ইউনিয়নের সাটিয়াচড়ায় ( বড় বাড়িতে ) অবস্থান করছেন। প্রবীর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেছেন। প্রণব কলকাতায় ।

বালিয়াটী পশ্চিম বাড়ীতে জীবনের বহু মূল্যবান সময় কাটিয়েছেন চারু শিল্পী খগেন্দ্র নাথ সাহা । যার ‍শিল্প কর্মের কথা অখ্যাতই রয়ে গেল। অথচ খগেন বাবু বড় মাপের একজন শিল্পী ছিলেন । টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার আহ্বানে একসময় তিনি মির্জাপুরের চলে যান। মির্জাপুরের “মির্জা হল’’ তার ছোঁয়ায় উজ্জল। খগেন বাবুর বড় ছেলে  বাদল বাবুও পিতার আংশিক গুনাগুণের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন।

এই পশ্চিম বাড়ীর তাল পুকুরের ধারে অনেক প্রাচীন  কাল থেকেই রথ উৎসব হত। বর্তমানে রথ টানের পর‌্যাপ্ত জায়গা পতিত না থাকাতে রথ উৎসব এখন হয় বালিয়াটি পুরান বাজারের কালী মুন্দিরের পাশে।

এই পুকুরেরই পশ্চিম  পাশে ১৩১৫ বঙ্গাব্দ থেকে জমিদারদের ব্যবস্থাপনায় শীতলা ও হনুমান পূজা হয়ে আসছে। জমিদারদের অবর্তমানে স্থানীয় ভক্তবৃন্দ যথারীতি উক্ত মন্দিরে হনুমানজী ও শীতলা মায়ের পুজো করে আসছেন। সাম্প্রতিক সময়ে উক্ত মন্দির প্রাঙ্গণে মহানামযজ্ঞ ও রাধাকৃষ্ণ লীলা কীর্তন অনুষ্ঠান যথাযোগ্য মর্যাদায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বালিয়াটি পূর্ব অংশে এ বাড়ীর অবস্থান বলেই পূর্ববাড়ী হয়েছে এ বাড়ীর নাম। রায়চাঁদ থেকেই এ বাড়ীর বংশে প্রসারণ ঘটেছে। রায়চাঁন (দু বিয়ে করেন)

রায়চাঁদ দু বিয়ে করেন। প্রথম পক্ষের স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানদের সম্পত্তির দশআনা অংশ এবং দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানদের সম্পত্তির ছ‘ আনা অংশ দান করেন। এই বাড়ীর কিছু অংশকে দশ আনীর জমিদার এবং কিছু অংশকে ছয় আনীর জমিদার বলা হয়ে থাকে।

দশআনীর জমিদার বাড়ীটি বর্তমানে দেশ বিদেশের পরিব্রাজকদের মনহরণ করে। এই বাড়ীটি ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর অধিগ্রহণ করেন এবং বর্তমানে এর সংস্কার কাজ চলছে। ১৩০০ বঙ্গাব্দের ১ লা বৈশাখ এই বাড়ীর জমিদারগণ গৃহপ্রবেশ করেন বলে জানা যায়। এই বাড়ীটি বালিয়াটি প্রাসাদ নামে খ্যাত। পশ্চিম থেকে পূর্ব পর্যন্ত যে চারটি সুবৃহৎ ও সুদৃশ্য অট্টলিকা নৈসর্গিক শোভাবর্ধন ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সিংহদ্বার সমৃদ্ধ ঐ চারটি বাড়ী বড় ,মেঝ, নয়া ও ছোট তরফ নামে জনশ্রুতিতে নিবদ্ধ। ছয় আনীর জমিদার বাড়ীর অস্তিত্ব আজ নেই্। ওখানে গড়ে উঠেছে বালিয়াটী দাখিল মাদ্রাসা ও একটি সরকারী চিকিৎসা কেন্দ্র। ১৬.৪০ একর বিশাল এলাকা জু’ড়ে ছিল এ বাড়ীর অবস্থান। ৫.৮৮ একর জমির উপরে বাড়ীর মূল সৌধমালা। ১০.৫২ একর জায়গার মধ্যে বিশাল বাগান , ;যেখানে এখন সাটুরিয়া উপজেলা সদর দপ্তর।

রায়চাঁদ বা রায়চাঁন বালিয়াটী পূর্ববাড়ীর জমিদারদের পূর্ব পুরুষ । রায়চাঁন ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন । শ্রীনবদ্বীপ ধাপে শ্যামসুন্দর ‍জিউ বিগ্রহ তিনি স্থাপন করে একটি বৃত্তির ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন । এই দেবালয়ই নবদ্বীপ ধামে বড় আখড়া নামে খ্যাত । এই আখড়াতে বহু অভ্যাগতদের আশ্রয় ‍মিলত। ১৯২১,২২ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব বাড়ীর দশআনীর জমিদাররা এই আখড়ার মন্দিরটি সংস্কার করে শ্বেত পাথরে শোভিত করেছিলেন এরং শ্রী রেবতী মোহন রায় চৌধুরী শ্যামসুন্দর ‍জিউ বিগ্রহের জন্য একটি রৌপ্য সিংহাসন প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন।

বড়তরফের প্রধান জমিদার রাজচন্দ্র , মেঝ তরফের প্রধান জমিদার ঈশ্বর চন্দ্র নয়া তরফের প্রধান জমিদার ভগবান চন্দ্র ছোট তরফের প্রধান জমিদার ভৈরব চন্দ্র।

ভগবান চন্দ্র , ভৈরব চন্দ্র, জগৎ চন্দ্র, হরেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরী ১২২৬ বঙ্গাব্দে যখন পূর্ববঙ্গে হাহাকার লেগেছিল তখন বালিয়াটীতে অন্নছত্র খুলে বহু দিন অজস্র অনাহারী মানুষের আহারের ব্যবস্থা করেছিলেন্ এবং এর অনেক আগে বালিয়াটী ‍গ্রামে আগুন লেগে বহু গরীব মানুষের বাড়ী ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেলে তারা ক্ষতিগ্রস্থদের বাড়ূী তৈরির জন্য যথেষ্ঠ টাকা সাহায্য করেছিলেন।

শরচ্চন্দ্র- তিনি বিশেষ কাজে সিরাজগঞ্জে থাকার সময় বহু সময় বহু ‍দিন সিরাজগঞ্জের অনানারী ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন।

গুরুপ্রসন্ন – বি,এ পাস করে ইংল্যান্ড গিয়ে বার-এ্যাট –ল ডিগ্রী নিয়ে এসেছিলেন। কলকাতা হাই কোর্টে দীর্ঘ  দিন তিনি আইন ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলেন ।

কালীপ্রসন্ন- বালিয়াটীতে ( বর্তমান উপজেলা সদর দপ্তর কার্যালয় ) তদের বাগান বাড়ীতে শ্যামসুন্দরের আখড়া প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরটি এখন নেই। মন্দিরটি খুবই সুদৃশ্য ছিল।

হরিপ্রসন্ন- একজন দক্ষ নাট্যাভিনেতা ছিলেন।

বিনয়কৃষ্ণ রায় চৌধুরী- ভাল একজন গায়েন ছিলেন। তার পিতার নাম রাধাকৃষ্ণরায় চৌধুরী । রাধাকৃষ্ণ অপর পুত্রের নাম রুপেন্দ্র কৃষ্ণ রায় চৌধুরী । সুশীল ও সুধীর রায় নামে দুই সহোদরের নাম পাওয়া যায়। সুধীর রায় চৌধুরী ভাল তবলা বাদক ছিলেন । সুধীর রায় চৌধুরীর ছেলে সুনীল ও সুধীর রায় চৌধুরী।

মেঝ তরফের জমিদার রায় বাহাদুর হরেন্দ্র কুমার বালিয়াটীতে নিজ পিতার  নামে ১৯১৯ সনের ১৬ জানুয়ারী ঈশ্বর চন্দ্র ইংরেজি উচ্চ ‍বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ‍বিদ্যালয় ভবনটি পাকা ৩৫০ ফুট দীর্ঘ এবং বারান্দাসমেত প্রস্থ ৪০ ফুট।

শ্রেনী কক্ষের সংখ্যা ১৩ টি , প্রতি কক্ষ ২২ ফুট দীর্ঘ , প্রস্থ ১৮ ফুট। এর সাথে রয়েছে পূর্বে পশ্চিমে  দুটি হল রুম । এই বিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হরেন্দ্র কুমারের অভিমানীপুত্র উপেন্দ্র কুমারের আত্মহত্যার হৃদয় বিদারক কাহিনী। একদিন রায় বাহাদুর হরেন্দ্র কুমার জমিদারী কোন এককাজে  বালিয়াটি থেকে কলকাতা রওয়ানা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন,সেই সময়ে পুত্র উপেন্দ্র কুমার পিতা হরেন্দ্র কুমার কে প্রস্তাব করেন- “ বাবা আমাদের তো অগাধ সম্পত্তি কিন্তু আমাদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য কিছুই  তো করলেন না ?” উত্তরে হরেন্দ্র বাবু খুব রেগে গিয়ে ছেলেকে বলেন – “ ক পয়সা রোজগার্ কর তুমি? স্মৃতি চিহ্নের প্রস্তাবটাতো দিতে পারলে?’’ এই বলে পুত্রের প্রস্তাব প্রত্যাখান করে হরেন্দ্র কুমার কলকাতা যাবার প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। অনুরাগে জর্জরিত হয়ে উপেন্দ্র কুমার একটা বন্দুক নিয়ে বসত বাড়ীর দোতলায় উঠে এক চেয়ারে বন্দকের গোড়া ‍রেখে পা দিয়ে ট্রিগার টিপে নিজের বুকে নিজেই গুলিবিদ্ধ করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন । তখন হরেণ বাবু পুত্রের এহেন মৃত্যুতে শোকে আপ্লুত হয়ে পড়েন । এবং কলকাতা যাত্রা বাতিল করে দিয়ে সিদ্ধান্ত নেন যে বালিয়াটিতে তিনি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করবেন। উপেন বাবু মৃত্যু দিয়ে এলাকা বাসীকে এমন একটি উপহার দিয়ে গেছেন যা বালিয়াটির অলংকার । এই বিদ্যালয় নির্মাণে রায় বাহাদুর হরেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরী তৎকালীন সময়ে ৫০ হাজার টাকারও বেশি ব্যয় করেছিলেন। বিদ্যালয়টি এখনো স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল উপমা হয়ে মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তর কালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের ঘনিষ্ট সহচর ত্রাণ ও ‍পুর্নবাসন মন্ত্রীর দায়িত্বরত অবস্থায় জনাব্ এ এইচ কামরুজ্জামান এ বিদ্যালয়ে শুভাগমন করেন।

হরেন্দ্র কুমারের দৌহিত্র নাগরপুরের কৃতিসন্তান ‍দ্বিজেন্দ্র প্রামাণিক বালিয়াটি  ঈশ্বর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় এর ম্যানেজিং কমিটির প্রথম সেক্রেটারি । তিনি বালিয়াটি   ইউনিয়ন কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন । ‍চিরকুমার ‍দ্বিজেন্দ্র প্রামাণিক বালিয়াটিতে “ বেকার বান্ধব ‍সমিতি “ প্রতিষ্ঠা করেন ।

বালিয়াটি  ঈশ্বর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে যারা প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন যথাক্রমে তারা হলেন- ‍নিবারণ চন্দ্র সরকার ( গ্রাম: নাগরপাড়া, মির্জাপুর) , যোগেন্দ্র নাথ সরকার (গ্রামঃ আমতা ,ধামরাই), ক্ষিতিশ চন্দ্র বসু রায় চৌধুরী ( গ্রামঃ আটিগ্রাম, সাটুরিয়া, বর্তমান মানিকগঞ্জ সদর) বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে খুব ঘনিষ্টতা ছিল তার । নজরুল ওনাকে মামা বলে সম্বোধন করতেন। জনাব মো: আব্দুল জলিল (গ্রামঃ ‍বৈলতলা,সাটুরিয়া), জনাব মোঃ মোতাহার আলী খান মজলিশ ( বরাইদ, সাটুরিয়া) ও জনাব মোঃ আরশেদ আলী চৌধুরী ( হাজিপুর, সাটুরিয়া)। বালিয়াটি  ঈশ্বর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশে স্কুলের জায়গায়  ১৯৬৬ সনে নির্মিত হয় বালিয়াটীর প্রথম মসজিদ। মসজিদ নির্মাণে নেতৃত্ব দেন বিদ্যালয়র তদানিন্তন প্রধান শিক্ষক জনাব মোঃ আব্দুল জলিল । তার সঙ্গে সক্রিয় সহযোগিতা করেন বিদ্যালয়ের , বালিয়াটী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক জনাব মোঃ আশরাফ আলী মিয়া, হাফেজ মোঃ শাহাব উদ্দিন , বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির তৎকালীন সেক্রেটারী জনাব শেখ মোঃ ইসমাইল এবং বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির তৎকালীন সভাপতি সাটুরিয়া থানা সি ও (উন্নয়ন ) জনাব এস এম জিল্লুর রহমান। উল্লেখ্য ১৯৬২ সনে প্রথম বালিয়াটিতে বালিয়াটি  ঈশ্বর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের পশ্চিম হলে বিদ্যালয়ের হেড মৌলানা জনাব মৌলানা মোঃ আজিজুর রহমানের অনুপ্রেরণায় বিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রথম আযান দিয়ে নামাজ আদায় করেন। এর আগে বালিয়াটীতে কখনো আযান হয়নি। ‍বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন তখন চিরকুমার বাবু ক্ষিতিশ চন্দ্র বসু রায় চৌধুরী।

যে বালিয়াটিতে ১৯৬২ এর পূর্ব পর্যন্ত শুধু ঘন্টা কাসর ও উলুধ্বনি শুনা যেত সেখানে এখন একই সাথে বালিয়াটি  ঈশ্বর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের মসজিদ সাটুরিয়া উপজেলা ক্যাম্পাসের মসজিদ ও বালিয়াটী মাদ্রাসার মসজিদ থেকে উচ্চস্বরে মোয়াজ্জিনের আযান আকাশ বাতাস মুখরিত করে তোলে। হিন্দু মুসলমান এখানে একই সাথে যেরকম  ঈদ উৎসব উপভোগ করে তেমনি পূজো পার্বণ ,দশমীর মেলা ,রথের মেলা , বারুনীর মেলা, ও চৈত্র সংক্রান্তির মেলা আনন্দ উৎসব ভাগাভাগি করে নেয় । বালিয়াটির সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনবদ্য উপমা। এখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী রাজনীতিক আছে কিন্তু এখানে কোন রাজনৈতিক নৈরাজ্য ও অস্থিরতা নেই। শুধু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নয়, এখানে রাজনৈতিক সম্প্রীতিও ‍বিরাজিত।

গুনেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরী হরেন্দ্র কুমারের সুযোগ্য ‍পুত্র। তিনি ছিলেন এ অঞ্চলের সিংহ পুরুষ। তিনি বালিয়াটীতে সৌখিন নাট্যগোষ্ঠী আরতি নাট্য  সমাজ প্রতিষ্ঠা করে সংস্কৃতি চর্চাকে বেগবান করেছিলেন।১৯১০ সনে বালিয়াটী রামকৃঞ মিশন প্রতিষ্ঠায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখে ছিলেন।এছাড়াও তার প্রচেষ্টায় ১৯২০ সনে বালিয়াটীতে “ বালিয়াটী স্টূডেন্টএ্যাসোসিয়েশন “ গঠিত হয়েছিল , যার মূখ্য উদ্দেশ্য ‍ছিল অত্র এলাকার স্কুল কলেজ পড়ুয়া ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে পাঠ্যভাস র গড়ে তোলা । কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত মানিকগঞ্জ সুহৃদ সম্মিলনীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন এই গুনেন্দ্র কুমার। তিনি ছিলেন সুদর্শন , সুঅভিনেতা, সুসংগঠক, সুশিক্ষিত এবং সুফুটবলার।

রামকৃষ্ণ মঠ ও ‍মিশনের মাসিক মুখপত্র “ উদ্বোধন পত্রিকায় চৌদ্দ বছর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন বালিয়াটীর সন্তান শ্রীমৎ স্বামী সুন্দরানন্দজী মহারাজ । পূর্বাশ্রমে এই সন্নাসীর নাম ছিল শ্রী রাধিকা মোহন অধিকারী। বালিয়াটি রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠায় শ্রীমৎ স্বামী সুন্দরানন্দজী মহারাজের আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা অনস্বীকার্য । তৎসময়ের বালিয়াটি শ্রীযুক্ত শ্রীনিবাস সাহা মহোদয়ের বাড়িতে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার প্রথম  আনুষ্ঠানিক মাঙ্গলিক ক্রিয়াদি দিয়ে সূচনা হয় । পরবর্তীতে এটি স্থানান্তরিত হয়ে বর্তমান স্থানে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৩২৯ বঙ্গাব্দে  শ্রীযুক্ত হরিবোলানাথ রায় চৌধুরী মহোদয় তার প্রয়াত পিতা ভ্রাতা, ভগ্নির উদ্দেশ্যে বর্তমান আশ্রমের জন্য এক ‍বিঘা (৩৩ শতক) ভূমি ক্রয় করে দেন। অতঃপর শ্রীমতি অঙ্গদেবী চৌধুরানী তার প্রয়াত পিতার স্মৃতির উদ্দেশ্যে ১৩৩১ বঙ্গাব্দে এই আশ্রমের প্রধান তোরণ নির্মাণ করে দেন।১৩৩১ বঙ্গাব্দের ১৪ই জ্যৈষ্ঠ সেবাশ্রমের অধিকাংশ সভ্যগণের ভোটে এই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করার জন্য একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়। উক্ত ট্রাস্টি বোর্ডের নির্বাচিত সদস্যগণের  নাম  ও ঠিকানাঃ

       ১। শ্রীমৎ স্বামী বাসুদেবানন্দজী মহারাজ           রামকৃষ্ণ মঠ, বেলুড়

       ২। শ্রীমৎ স্বামী কমলেশানন্দজী মহারাজ                                  ‘’

       ৩। শ্রীমৎ স্বামী মুক্তেশ্বরানন্দজী মহারাজ                                 ‘’

       ৪। ব্রঃ ধ্যানচৈতন্য ( পরবর্তীতে স্বামী সুন্দরানন্দজী মহারাজ )    ‘’

       ৫। ব্রঃ গণেন্দ্রনাথ                                                                   ‘’

       ৬। শ্রীযুক্ত যামিনী লাল রায় চৌধুরী                                   বালিয়াটী

        ৭। শ্রীযুক্ত হরিবোলানাথ রায় চৌধুরী                                       ‘’

        ৮। শ্রীযুক্ত অমূল্যচন্দ্র রায় চৌধুরী                                          ‘’

        ৯। শ্রীযুক্ত দ্বিজেন্দ্র কুমার প্রামাণিক                  বালিয়াটী ( নাগরপুর)       

১০। শ্রী সত্যচরণ সাহা                                                    বালিয়াটী 

স্বামী সুন্দরানন্দজী মহারাজ একজন সুবক্তা ছিলেন। বিভিন্ন ধর্মসভায়  শ্রী রামকৃষ্ণ , বিবেকানন্দ ভাবাদর্শে ও দর্শনে বক্ততা করে তিনি সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে শ্রীরামকৃষ্ণভাব জাগিয়ে দিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি যখন রাঁচি রামকৃষ্ণ মিশনে ছিলেন তখন ‘‘ মনের রহস্য ‘’ নামে একখানি পুস্তিকা লিখেন।

বালিয়াটী রামকৃষ্ণ মিশনকে তিনি এই বই উপসর্গ করেছিলেন। বইটির প্রকাশক ছিলেন বালিয়াটির প্রয়াত শ্রী হেমেন্দ্র লাল সাহা । স্বামীজির উদ্দেশ্যে তার লেখা “ যুগচতুষ্ঠায় বই খানির সর্বস্বত্ব কলকাতা বিবেকানন্দ সোসাইটিকে দান করেছিলেন। তার লেখা অন্যতম বই  হচ্ছে-

“ Hinduism and Untouchibility’’

বালিয়াটী রামকৃষ্ণ মিশন সেবাশ্রমে বিভিন্ন সময়ে যে সকল প্রবীণ সন্নাসী বেলুড় মঠের নির্দেশে দায়িত্বপ্রাপ্ত ও কর্মী হিসেবে অবস্থান করেছেন তাঁরা হলেন স্বামী ধর্মানন্দজী , স্বামী ক্ষেমানন্দজী ,স্বামী সর্বাত্মনন্দজী স্বামী সীতারামনন্দজী  ও স্বামী তাপসানন্দজী মহারাজ।  স্বামী তাপসানন্দজী (লালজী মহারাজ) ঠাকুর  শ্রীরামকৃষ্ণের সহধর্মিনী শ্রীমা সারদা দেবীর মন্ত্রাশ্রিত ছিলেন। এ আশ্রম পরিদর্শনে আরও এসেছেন স্বামী ভূতেশানন্দজী মহারাজ পরবর্তীতে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের দ্বাদশ সংঘগুরু , স্বামী গহনানন্দজী মহারাজ পরবর্তীতে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের চতুর্দশ সংঘগুরু । শ্রী মৎস্বামী প্রভানন্দজী মহারাজ ( বর্তমানে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সাধারণ সম্পাদক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তর কাল থেকে বালিয়াটী রামকৃষ্ণ মিশন সেবাশ্রমের ব্যবস্থাপনা পরিষদের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন ঢাকা রামকৃষ্ণ মঠ ও ‍মিশনের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ স্বামী অক্ষরানন্দজী মহারাজ । এছাড়াও এই মঠে এসেছেন ভক্তিবিনোদ ভারতী মহারাজ ও আসাম সারস্বত মঠের স্বামী নিগমানন্দজী মহারাজ। বর্তমানে এ আশ্রমের অধ্যক্ষের দায়িত্বে আছেন স্বামী পরিমুক্তানন্দজী মহারাজ।

রামকৃষ্ণ মিশন ও গদাই গৌরাঙ্গ মঠের মধ্যবর্তী সাড়ে চার আনির মাঠ যার বর্তমান নাম উত্তর মাঠ সেখানে এখন শারদীয় দূর্গাপূজোর দশমী দিবসে বালিয়াটীর ঐতিহ্যবাহী দশমীর মেলা বসে। এর আগে বালিয়াটী নিতাই গৌড়ের  আখড়ার উত্তরপাশে এ মেলা বসতো।

নয়া তরফের জমিদার মহমোহন ১৩৩২ সনের ২রা কার্তিক স্ত্রী ইন্দুবালা ও কন্যা সুনীতিবালার স্মৃতি রক্ষার্থে বালিয়াটীতে শ্রী শ্রী গদাই গোরাঙ্গ মঠ স্থাপন করেন। টাঙ্গইল  জেলার নাগরপুর উপজেলার পাকুটিয়ার সুবিখ্যাত জমিদার স্বর্গীয় বৃন্দাবন চন্দ্র রায়চৌধুরীর স্মৃতিকল্পে তার স্ত্রী শ্রীযুক্তা শিবসুন্দরী রায়চৌধুরাণী বালিয়াটী শ্রী শ্রী হরিভক্তি প্রদায়িনী সভার ব্যবহায্যে ও জনসাধারণের পানীয়ার্থে এই মঠের উত্তর-পূর্ব পাশে ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ১৫ বৈশাখ একটি ইন্দরা নির্মাণ করিয়ে দেন যেটি এখনও প্রস্থর ফলকসহ অক্ষত বর্তমান। ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে মনমোহন পিতা রেবতী মোহনের স্মৃতি রক্ষার্থে  ঐ মন্দির গাত্রে মার্বেল পাথর স্থাপন করেন । ঢাকার নারিন্দায় মনমোহন রায় চৌধুরী শ্রী শ্রী মাধ্ব গৌড়ীয় মঠ স্থাপন করেন। ১৩৩৬ সনে বালিয়াটী এবং ঢাকার মঠ উদ্বোধনের জন্য এসেছিলেন ভারতের পশ্চিম বাংলার নদীয়া জেলার মায়াপুর থেকে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের প্রভুপাদ শ্রীল ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী মহারাজ । ‍শ্রী মনমোহন  বৈষ্ণব মতে সবিশেষ অনুরাগী ছিলেন এবং মন্দিরটি তার গুরু সরস্বতী গান্ধীর নামে উৎসর্গ করেছিলেন।

ষোড়শী মোহন পরলোকগত পুত্র সুধেন্দ্র মোহনের স্মৃতি রক্ষাকল্পে ১৩৫৫ বঙ্গাব্দে ৬ই ফাল্গুন বালিয়াটী গদাই গৌরাঙ্গ মঠের পূর্বপাশে সিমেন্টের বড় তোরণ তৈরী করেন। সেটি এখন নেই। গদাধর মহারাজের মাতুল ভূমি এ অঞ্চলে বিধায় এই মঠের নাম হয়েছিল শ্রী শ্রী গদাই গৌরাঙ্গ মঠ । এই মঠের বর্তমান সেবায়েত হচ্ছেন ক্ষিতিশ কৃষ্ণ দাসাধিকারী।

দীনেন্দ্রনাথ ছিলেন আলোড়ন সৃষ্টিকারী ব্যক্তিত্ব। তিনি দীনা পাগলা নামে পরিচিত ছিলেন । বালিয়াটিতে প্রথম বড় মাপের ফুটবলের আসর বসেছিল তার প্রচেষ্টায় । ঐ সময় কলকাতার ইস্ট বেঙ্গল ক্লাব , ঢাকার ওয়ারী ফুটবল ক্লাব বালিয়াটীতে এই টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছিল। পিতা দেবেন্দ্রনাথের স্মৃতি রক্ষাকল্পে তিনি বালিয়াটী  রামকৃষ্ণ মিশন সেবাশ্রম ও জনসাধারণ উদ্দেশ্যে  ১৩৩১ বঙ্গাব্দের ৯ই জ্যৈষ্ঠ একটা পাকা ইন্দারা নির্মাণ করেন যা এখনও বর্তমান।

হরিবোলানাথ রায় চৌধুরী তার পিতা হরনাথ , ভাই শ্রীনাথ , বোন হৈমবতীর স্মৃতি স্মরণার্থে বালিয়াটী রামকৃষ্ণ মিশন সেবাশ্রমের মন্দির নির্মাণে ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের ২৫ শে বৈশাখ ৩০১ ( তিনশত এক ) টাকা দান করেছিলেন । সীতানাথ ছিলেন জানকীনাথের পুত্র । সীতানাথ রায় চৌধুরী ছিলেন একজন ভাল মঞ্চাভিনেতা ও ফুটবলার ।

শ্রী রমানাথ রায় চৌধুরীর পুত্রত্রয় , রঘুনাথ, রমেন্দ্রনাথ, রণেন্দ্রনাথ, মা কৃষ্ণভাবিনী রায় চৌধুরাণীর স্মৃতি চিহ্নের কারণে বালিয়াটী রামকৃষ্ণ মিশন মন্দির নির্মাণে ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের বৈশাখের ২৫ তারিখে ৩০১ ( তিনশত  এক ) টাকা দান করেছিলেন।

প্রমদানাথ রায় চৌধুরী বিয়ে করেছিলেন টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুরের খ্যাতনামা দানবীর শহীদ রণদা প্রসাদ সাহার বড় মেয়ে বিজয়া সাহাকে। প্রমদানাথের মৃত্যুর পর বিজয়া টাঙ্গাইলের লাউহাটীর ধনাঢ্য ব্যক্তি মরহুম আরফান খান সাহেবের সুযোগ্য পুত্র ব্যারিস্টার শওকত আলী খানের সঙ্গে ঘর বাঁধেন।

বালিয়াটী পূর্ব বাড়ীর ছয় আনীর জমিদারদের পরিচারিকা বালিয়াটীর সত্যবালা দাসী ( মালিনী ) ১৩১৮ বঙ্গাব্দে বালিয়াটীতে নিতাই গৌরের আখড়া প্রতিষ্ঠা করেন। এই মন্দির প্রতিষ্ঠায় ছয় আনীর জমিদারদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা ছিল। ছোট্ট একটা কাহিনী রয়েছে। এই মন্দির প্রতিষ্ঠায় অন্তরালে। সত্যবালা একদিন রাতে স্বপ্ন দেখলেন যে, “ বালিয়াটির উত্তর পাশ ঘেষেঁ বহে যাওয়া ধলেশ্বরীর শাখা গাজীখালী  মতান্তরে এলান নদী  দিয়ে কাষ্ঠ নির্মিত দুটো মূর্তি নিতাই এবং গৌর ভেসে যাচ্ছে। স্বপ্নে তিনি আদিষ্ট হন মূর্তি দুটো তুলে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করতে। “সকাল হলে তিনি তার স্বপ্নের কাহিনী মুনীব জমিদারদের জানালেন। জমিদাররা লোক লাগিয়ে দিলেন নদীতে জাল ফেলে মূর্তি দুটো উদ্ধার করতে। মূর্তি উদ্ধার হলে সত্যবালা তার সারাজীবনের পারিশ্রমিকের ফসল সাঞ্চিত অর্থের বিনিময়ে জমিদারদের সহযোগিতায় বালিয়াটীতে নিতাই গৌরের আখড়া প্রতিষ্ঠা করে মূর্তি স্থাপন করলেন।জমিদারগণ নিজেদের উদ্যোগে নিতাই গৌর বিগ্রহের জন্য স্বর্ণের মূল্যবান অলংকারদি গড়িয়ে দিলেন। কিছু বছর অতিবাহিত হবার পর ঘন ঘন চোরের উপদ্রবের কারণে জমিদারগণ অলংকার গুলো বিক্রি করে ‍দিয়ে নিত্যসেবা পূজা ও উৎসবাদি উদযাপনের লক্ষে বিগ্রহের নামে বেশ কিছু ফসলী জমি ক্রয় করেন। মন্দির প্রতিষ্ঠা লগ্নের পূজারী ছিলেন ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের দামোদরজী মহাশয় । দামোদার ঠাকুর মশাইয়ের কাছ থেকে এ মন্দিরের পরবর্তী সময়ের পূজারী বীরেন্দ্র কুমার গোস্বামী এ তথ্যাদি জেনেছিলেন। আজও সেই সময়ের ক্রয়কৃত জমির উৎপাদিত ফসলেই নিতাই গৌর বিগ্রহের সেবা পূজা সহ অন্যান্য অনুষ্ঠানাদি যথারীতি চলছে । মন্দিরটি সম্প্রতি পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে।

ছয় আনির জমিদার অবিনাশ চন্দ্র রায় চৌধুরী বি. এল পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হয়ে ঢাকা জেলা জজ আদালতে এ শতকের প্রথমপাদে আইন ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলেন বলে জানা যায়।

পূর্ব বাড়ীর জমিদারদের শারদীয় দুর্গোৎসব এ অঞ্চলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল। বর্তমানে এলাকাবাসী আর্থিক অনটনের কারণে নিতান্তই দায়সারা গোছের আয়োজনে ঐ পূজো সম্পন্ন করছেন। অথচ দুর্গাপূজোর সময় জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় কোলকাতা বিখ্যাত যাত্রা পার্টি নট্ট কোম্পানী এখানে যাত্রা পালা গাইতে এসেছে একাধিকবার । তখন বালিয়াটির পূর্ব বাড়ীর জমিদারদের নিকটতম আত্মীয় আমতার মাতৃসাধক ও লোক কবি ভবা পাগলা এবং নট্ট কোম্পানীর বেহালাবাদকের সঙ্গে বেহালাবাদনের অঘোষিত প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছেন জমিদাররা । প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী জানা যায় ভবা পাগলার বেহালাবাদনের মুন্সীয়ানার কাছে নট্ট কোম্পানীর পেশাদার বেহালার বাদক হার মেনেছে । মাতৃসাধক ভবা পাগলা জন্মে ছিলেন বালিয়াটীর পাশের গ্রাম ধামরাই থানার আমতা গ্রামে । তিনি অসংখ্য গান লিখেছেন ,সুর করেছেন  এবং গাইতেও পারতেন। তিনি প্রথমে পড়াশুনা করেন আমতা মাইনর স্কুলে যে স্কুলটি এখন আমতা হরলাল উচ্চ বিদ্যালয় । আমতা থেকে পরে তিনি বালিয়াটির মাইল সাতেক পশ্চিমে পাকুটিয়া বি ,সি , আর , জি উচ্চ বিদ্যালয়ে মাইনর ক্লাসে পড়শোনা করেছেন । ভবাপাগলার মন্ত্রপূতশিষ্য তরণী পাগলের কাছ থেকে জানা যায় ভবাপাগলার কাছ থেকে তিনি শুনেছেন আমতা থেকে চড়া রৌদ্রে পাকুটিয়া যাবার সময়ে দ্বিমুখা বাজার থেকে পাচতাড়াইল এর মধ্যবর্তী স্থানে স্বয়ং মহাদেব তাকে ( পাগলাকে ) দীক্ষা দিয়েছেন। বালিয়াটীর দশ আনীর বড় তরফে ভবাপাগলার পিসিমনির বিয়ে হয়েছিল । সেই সুত্রে এই বাড়িতে ভবাপাগলার ছিল অবাধ যাতায়াত।

স্বদেশী আন্দোলনের সময় চারণ কবি মুকুন্দ দাস গণ মানুষের চেতনা জাগানোর উদ্দেশ্যে  বালিয়াটী এসে বৃটিশ বিরোধী গান গেয়েছেন । বৃটিশ বিরোধী গান পরিবেশনের অপরাধের তৎকালীন সাটুরিয়া থানার দারোগা চারণ কবিকে গ্রেফতার করে সাটুরিয়া নিয়ে গেলে বালিয়াটী রামকৃষ্ণ মিশনের সে সময়ের অধ্যক্ষ স্বামী সীতারামানন্দজী মহারাজের হস্তক্ষেপে তিনি মুক্ত হন। গোলাপ রাম হচ্ছেন এই বাড়ীর প্রধান পুরুষ । গোপাল চন্দ্র রায় চৌধুরী , গৌরহরি রায়চৌধুরী দত্তকপুত্র মহিম রায় চৌধুরী , পূর্ণচন্দ্র , সতীশচন্দ্র ,  বগলা, রাধাশ্যাম, রুহিনী ,সুরেশ, অজিত , নিরন্জন , শৈলেন্দ্র, ভবানী শংকর, রামকৃষ্ণ সহ ‍বিক্ষিপ্তকিছু জমিদারের নাম পাওয়া যায়। এই বাড়ীর এক তেজস্বিনী মহিলা জমিদারের নাম উজ্জলা রাণী রায় চৌধুরাণী । এই বাড়িটি স্থাপত্যকলার দিক থেকে বেশ প্রাচীন।

পন্ডিত রাম হচ্ছেন এই বাড়ীর আদিপুরুষ । তিনি ভোলানাথ বসুর কাছ থেকে জমিদারীর কিছু অংশ কিনে ছিলেন । যতটুকু জানা যায় ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে এই বংশের গোপাল চরণ , মতিচাঁদ , পুলিন বিহারী , নিকুন্জ বিহারী  শশধর , মাধবেন্দ্র শাম্বিকা চরণ , প্রাণকুমার , গৌরচাঁন, স্বর্ণসুন্দরী , গোষ্ঠবিহারীর নাম পাওয়া যায় । উল্লেখ্য শাম্বিকা চারণের মেয়ে কিরণ বালাকে বিয়ে করেছিলেন টাঙ্গাইলের ‍মির্জাপুরের দানবীর শহীদ রণদা প্রসাদ সাহা । তিনি বালিয়াটিতে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা  করতে চেয়েছিলেন।কিন্তু জমিদাররা অনুমতি দেননি বলে পরবর্তীতে তিনি নিজগ্রাম মির্জাপুরে তার মায়ের নামে কুমুদিনী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সনে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী নরঘাতকরা আর.পি সাহাকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তিনি আর ফিরে আসেননি । মামলা মোকদ্দমা ও নানাবিধ কারণে এই জমিদারদের আর্থিক অবস্থা ভেঙ্গে পড়লে তারা বালিয়াটীর বিশিষ্ট ব্যবসায়ী গয়ানাথ সাহার কাছে নিজেদের মূল্যবান অলংকারাদি বিক্রি করে দিনাতিপাত করতেন বলে জানা যায়।

১২০৪ বঙ্গাব্দ থেকে  ১৩৪৪ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত সময়কালে বালিয়াটির জমিদররাই বংশ পরস্পর চারখানা রথ তৈরী করে দেন। ঢাকা আর্ট কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের জন্য ধামরাই রথের শিল্পকর্ম সিলেবাসভুক্ত ছিল। রথের ঘোড়া দুটো খোদাই করেছিলেন বালিয়াটির যোগেন্দ্রলাল সুত্রধর । ছোট তরফের জমিদার ভৈরব চন্দ্রের পুত্র দেবেন্দ্র নাথ ধামরাইয়ের যশোমাধব দেবের সুদৃশ্য রৌপ্য সিংহাসন তৈরী করে দিয়েছিলেন। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জের ঠিকাদার সূর্য নারায়ণ সাহার মাধ্যমে যে রথটি তৈরী হয় ১৯৭১ সনে পাকিস্তানী পিশাচতূল্য সৈন্যরা সে রথটি পুড়িয়ের দেয়। তার উচ্চতা ছিল পতাকা সমেত ৬০ ফুট । অতি সম্প্রতি ভারতীয় হাই কমিশনের মাধ্যমে ভারত সরকারের এক কোটি টাকা আর্থিক সহযোগিতায় ধামরাইয়ের রথ নতুন  করে কারুকার্য খচিত ও দৃষ্টি নন্দন করে নির্মিত হয়েছে। ১৪১৭ বঙ্গাব্দের রথ উৎসবে নতুন রথের শুভ উদ্বোধন হয়েছে।

বালিয়াটীর পূর্ব বাড়ী ও পশ্চিম বাড়ীর জমিদারদের কুলবিগ্রহের নাম রাজরাজেশ্বর । পালাক্রমে বিভিন্ন বাড়ীর বিভিন্ন তরফে তিনি পূজিত হতেন । বর্তমানে জমিদারদের কুলবিগ্রহ প্রস্তরের রাজরাজেশ্বর  কলকাতায় ৪ নম্বর শোভাবাজার স্ট্রীটে বালিয়াটি জমিদারদের বর্তমান উত্তরাধিকারীদের বাড়ীতে পূজিত হচ্ছেন।

বালিয়াটীর পরিচিতি তথা বালিয়াটি নিয়ে কথকতা , অনুসন্ধিৎসা এমনকি গবেষণা সবকিছুই বালিয়াটির জমিদারদের ঘিরেই।জমিদারদের ভাল-মন্দ  নিয়েই বালিয়াটির জমিদারদের ইতিহাস। জমিদারদের কীর্তি , সুখ্যাতির অন্তরালে কুখ্যাতিগুলো এড়িয়ে গেলে সত্য গোপন হবে। কোন সাধারণ মানুষ এই জমিদার বাড়ীর সম্মুখ দিয়ে ছাতা মাথায় দিয়ে যেতে পারতো না। যদি কখনো কদাচিৎ কেউ ছাতা ব্যবহারের ব্যবহারের ব্যর্থ চেষ্টা করেছে তাকে কঠোর শাস্তি দেয়া হতো । জমিদারদের পুকুরে কোন সাধারণ প্রজার স্নান করা, সাবান ব্যবহার করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ছিল । এর ব্যতিক্রম ঘটলে তার বুকে পাথর চাপা দেওয়া হতো । প্রজা সাধারণের কোন সুন্দরী যুবতী বধূ অথবা কন্যা জমিদারের লোলুপ দৃষ্টির কবলে পড়লে তার রেহাই পাওয়ার কোন উপায় থাকতো না ।

জমিদারদের পোশাক পরিচ্ছদের সঙ্গে কোন প্রজা বা জমিদারদের কর্মচারীর পোশাকের সাদৃশ্য ধরা পড়লে উক্ত প্রজা বা কর্মচারীর উপযুক্ত কৈফিয়ত দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হতো। জমিদার প্রবর্তিত বিধি মোতাবেক কোন প্রজা সাধারণ খাজনা পরিশোধে ব্যর্থ হলে তার জায়গা – জমি হারাতে হতো।

সুদুর নেপাল ও পাঞ্জাব থেকে সুঠাম দেহধারী যুবকদের এনে জমিদাররা দারোয়ানের চাকুরী দিতেন । তন্মধ্যে প্রবীণেরা নেপালী রবিলাল ও পাঞ্জাবী জলা সিং এর নাম এখনো ভুলতে পারেননি। বিশেষ করে চিরকুমার  রবিলাল বালিয়াটিকে এত বেশী ভালবেসেছিলেন যে, জমিদারী পতনের পরও তিনি তার স্বদেশ নেপালে ফিরে যান নি । দীর্ঘদিন তিনি বালিয়াটী বসবাস করে এদেশেই পরলোক গমন করেছেন ।

বালিয়াটি সংলগ্ন একটি গ্রাম হাজিপুর। জনশ্রুতি আছে এই গ্রামে ঠাকুর কায়ছায় খান নামে প্রতাপশালী এক ব্যক্তি ছিলেন। শোনা যায় তিনি নাকি ব্রাহ্মণ সন্তান ছিলেন। পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ঠাকুর কায়ছার খান নামে পরিচিতি লাভ করেন। এই ঠাকুর কায়ছার খানের বংশ পরম্পরায় পারিবারিক ও সামাজিক ঐতিহ্য স্মরণযোগ্য।

ঠাকুর কায়ছার খানের পুত্র মরহুম আব্দুল জলিল খান অবিভক্ত ভারতের ইন্সপেক্টর অব পুলিশ ছিলেন । তিনি তার কর্মদক্ষতায় ভারত সরকারের পক্ষ থেকে একটি স্বর্ণ পদক ও একটি স্বর্ণের পকেট ঘড়ি সম্মাননা পেয়েছিলেন।

আব্দুল জলিল খান পাঁচ পুত্র সন্তানের জনক ছিলেন । পুত্র সন্তান যথাক্রমে আজিজুর রহমান খান ( নয়া মিয়া ) , আব্দুস সামাদ খান ( কুটি মিয়া),লুৎফর রহমান খান ( চাঁন মিয়া ), ফজলুর রহমান খান ( ফজলু মিয়া ) ও মিজানুর রহমান খান ( মিজু মিয়া )।

২০০৭ সনে বেসরকারি রেডিও ‘ রেডিও ফূর্তি ‘ বাংলাদেশের প্রাচীন স্থাপনাগুলোর মধ্যে মোবাইল ফোনের এস এম এস এর মাধ্যমে একটি সমীক্ষা চালায় , তাতে প্রথম হয় জাতীয় স্মৃতি সৌধ, দ্বিতীয় ঢাকার কার্জন হল  এবং তৃতীয় হয় বালিয়াটি জমিদার বাড়ী ।

উত্থান পতন পৃথিবীর চিরন্তন রীতি । বালিয়াটি জমিদারদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। জমিদারগণ একদিন এ গ্রামসহ সন্নিহিত এলাকাকে শোষণ করেছে, এলাকাবাসীকে অত্যাচার করেছে এবং বৃটিশের সরাসরি তাবেদারী জমিদারদের সর্বস্তরের মানুষ আজ ধিক্কার দেয়। শিক্ষা , সংস্কৃতি ও ক্রীড়ার ক্ষেত্রে তাঁদের যে অসামান্য অবদান ও প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা তা অবিস্মরণীয় । এদের মধ্যে বিশেষ করে কিশোরী লাল রায় চৌধুরীকে নিয়ে এলাকাবাসী শ্রদ্ধায় ছড়াকাটে—

“ ডালের মধ্যে মসুরী,

বাবুর মধ্যে কিশোরী। 

সংগ্রহ: বালিয়াটির ইতিকথা

লেখক: সমরেন্দু সাহা লাহোর

Scroll to Top